শেখ লুৎফর রহমান রহমান সাহেব বসে আছেন তাঁদের টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির বারান্দায়। কবুতরগুলো বাকবাকুম রব তুলে গলার পালক ফুলিয়ে ডাকছে। কবুতরের বাসাটা চারটা বাঁশের ওপরে, ঘরের দেয়াল ঘেঁষে। সুন্দর ডিজাইনের এই দোতলাটা লুৎফর রহমান সাহেব কিছুদিন আগে করেছেন। খোকা বাড়ি এলে দুনিয়ার লোক এসে বাড়ি ভরে যায়। ১৯৬৯ সালে ক্যান্টনমেন্টের বন্দিশালা থেকে বের হয়ে লঞ্চ ভাড়া করে যখন খোকা সবাইকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছিল, তখন ইউসুফ হারুন সাহেব হেলিকপ্টার নিয়ে এসেছিলেন। কাজেই বাড়িঘর ভালো করা দরকার। তাতে সুবিধা হয়েছে।
তবে সারা বছর বাড়ি তো খালিই পড়ে থাকে। লুৎফর রহমান সাহেব এবং খোকার মা মাঝেমধ্যে ঢাকায় গিয়ে থাকেন। নাসেরও তো থাকে খুলনা। বাড়ি তো বলতে গেলে ফাঁকা। এখন তিনি আছেন, খোকার মা আছে। একটা ঘরই লাগে। বাকি ঘরগুলো বছর ধরে পড়ে থাকে।
একটা কাক ডেকে উঠল বাড়ির পেছনের শজনেগাছের ডালে।
কাক কেন ডাকে? অনেক দিন আগে লুৎফর রহমান সাহেব একটা বটতলার বই দেখেছিলেন, কোন প্রহরে কার ডাকের কী ব্যাখ্যা। কাকের ডাকের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর কোনো যোগ আছে—এই সব কুসংস্কারে তাঁর একেবারেই সায় ছিল না কখনো। তবু আজ তাঁর মনে অজানা শঙ্কা এসে ভর করল।
আরশাদ কাঁসার গেলাস হাতে এসে পাশে দাঁড়াল।
লুৎফর রহমান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী?’
আরশাদ বলল, ‘ডাবের পানি। খান। আপনের না পেশাবে সমস্যা। একটু খান। পেশাব ক্লিয়ার হবেনে।’
লুৎফর রহমান সাহেব গেলাস হাতে নিয়ে বললেন, ‘খোকার মারে দিছ?’
‘জি। দিছি।’
‘খোকার মা কই?’
‘পাকঘরে।’
‘গরমের মধ্যে পাকঘরে গেছে ক্যান? শেফালির মা নাই?’
‘খালা পাকঘরে না গিয়া পারে না। অভ্যাস।’
‘ঠিকই কইছ। অভ্যাস। দেশের খবর কী?’
‘আর কোনো খবর নাই। মুক্তিফৌজ ভালো যুদ্ধ করতেছে। এইটা খালি জানি।’
‘খোকার আর কোনো খবর পাইছ?’
‘না। পাই নাই তো। করাচিতে রাখছে মনে হয়।’
‘রেনুর কোনো খবর পাইছ?’
‘না। নতুন খবর পাই নাই কিছু। শুনলাম ভাবিরে নাকি বাড়িতে আটকায়া রাখছে।’
‘গরুগুলান রে পানি দিছ?’
‘জি দিছি।’
‘আয়নাল কই। খেতে গেছে?’
‘জি গেছে।’
‘আইব কখন?’
‘এই তো। বেলা তো অনেক হইছে। আয়া পড়ব।’
‘জামিল কি গরুর ঘাস কাটতে গেছে?’
‘জি গেছে।’
লুৎফর রহমানের বয়স কত কেউ জানে না। তিনি বলেন, ‘এইটি প্লাস।’ সেই কবে তিনি আদালতের চাকরি ছেড়েছেন।
তাঁর গায়ে একটা গেঞ্জি। গেঞ্জির হাতা কনুই পর্যন্ত নেমে গেছে। তার নিচে সাদা ফরসা হাতের চামড়া কোঁচকানো। আর তাতে সাদা সাদা রোম। পরনে লুঙ্গি।
সায়েরা খাতুন পাকঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তিনি ঘেমে গেছেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘কাশেম নাকি জাল নিয়ে গেছে খালে। মাছ আনলে কখন আনবে? মাছ কুটতে হবে। ঝামেলা না। তুমি ভর্তা খাইতে চেয়েছ, পুইড়ে করব নাকি পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে চচ্চড়ি করে নিয়ে ভর্তা কইরে দেব?’
লুৎফর রহমান হাসেন।
‘হাসো ক্যানো?’
‘আমি তো ভর্তা খাইতে চাই নাই। কাশেম বানায় বানায় কথা কয়েছে।’
‘নামাজের ওয়াক্ত হতে কত বাকি?’
‘এখনো তো হয় নাই টাইম।’
‘কালকে নাকি রেডিওতে কয়েছে, সাতক্ষীরাতে যুদ্ধ হয়েছে। নাসেরের জন্যি চিন্তা হচ্ছে।’ সায়েরা খাতুন বললেন।
‘তোমারে কে বলল?’
‘শেফালি এসেছিল অর মার জন্য তেল নিতে। অর কাছে শুনলাম। লিলির মেয়ে দুইটা নাকি তার দাদার বাড়ি গেছে।’
‘গেলে তো ভালো। কিন্তু শহর বলো, গ্রাম বলো কোনো কিছু কি আর নিরাপদ আছে?’
হঠাৎই হইহই শব্দ উঠল। চালের ওপর কবুতরগুলো উড়ে উঠল। বাড়ির খোলায় বাঁধা বাছুরটা দড়ি ছিঁড়ে পালাতে চাইছে। কাক ডেকে উঠছে কা কা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে কুকুরগুলো উঠেই ঘেউ ঘেউ করতে করতে তেড়ে গেল বাইরে।
দৌড়ে এল ওই বাড়ির আয়নাল। ‘দাদি দাদি, দাদা দাদা, পালাতে হবি গো।’
‘ক্যান, পালাতে হবি ক্যান?’ লুৎফর রহমান সাহেব বললেন।
‘মিলিটারি আসতিছে।’
‘মিলিটারি এলে আসবে। আমাদের পালাতে হবি ক্যান?’
‘মিলিটারি কি মানুষ? তারা তো পশু। কিছু বুঝে না। খালি মানুষ মারে। দাদা-দাদি আপনেরা পালিয়ে যান।’
‘পালিয়ে যাব কই? আর এই বয়সে আমি দৌড়াতে পারব? যা তো। যা হবার হবি।’ লুৎফর রহমান নির্বিকার মুখে বললেন।
কাশেম ভেজা শরীরে পানি টপ টপ করে ফেলতে ফেলতে জালটা উঠানে রাখল। বলল, ‘দাদা, মিলিটারি আসতিছে। পালাতে হবি গো।’
জামিল দৌড়ে এসে গরুর জন্য ঘাস কাটার খুরপিটা বাড়ির পেছনের গোয়ালের বেড়াতে গুঁজে রাখল। হাতের ডালিটায় কিছু দূর্বাঘাস দেখা যাচ্ছে। জামিল বলল, ‘দাদা, মিলিটারি আসতিছে গো।’
‘চুপ করে থাক’—সায়েরা খাতুন বললেন।
কথা শেষ হওয়ার আগেই তিন দিক থেকে অস্ত্র উঁচিয়ে খাকি পোশাক পরা সৈন্যরা এসে দাঁড়াল বাড়ির উঠানে। তারা তাক করল অস্ত্র। হ্যান্ডস আপ।
শেখ লুৎফর রহমান বললেন, ‘বাবারা, মাথা ঠান্ডা করো। আমার বয়স এইটির বেশি। আই অ্যাম এইটি প্লাস। আমার এক পা কবরে। আমাকে অস্ত্রের ভয় দেখাচ্ছ ক্যানো? অস্ত্র নামাও। কী চাও, বলো।’
লুৎফর রহমান সেগুন কাঠের চেয়ারে বসেই রইলেন। সায়েরা খাতুন তাঁর হাতল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
‘হু ইজ লুৎফর রহমান?’
‘আই অ্যাম লুৎফর রহমান।’
‘ইয়োর সন ইজ দ্য এনিমি অব পাকিস্তান। ইয়োর সন ইজ দ্য এনিমি অব কায়েদে আজম। হি উইল বি পানিশড। সার্চ দ্য হাউস।’
সৈন্যরা বাড়ির ভেতরে গেল। এই ভবনের নিচতলা, দোতলা, খাটের নিচ ভালো করে তল্লাশি চালাল।
সৈন্যদের কমান্ডার বলল, ‘এই বুড্ঢা। বারান্দা থেকে নামো। বুড্ঢি নামো। আমরা বাড়িতে আগুন দেব।’
লুৎফর রহমান জানেন, উত্তেজিত সৈনিকদের সঙ্গে তর্ক করতে নেই। তিনি সায়েরা খাতুনকে বললেন, ‘চলো।’
সায়েরা খাতুন বললেন, ‘ঘরে কোরআন শরিফ আছে। নিয়ে আসি।’
লুৎফর রহমান বললেন, ‘দেয়ার ইজ আ কোরআন শরিফ ইন দ্য রুম। শি ইজ গোয়িং টু পিক দ্যাট।’
‘ইউ হিন্দু। হোয়াট কোরআন? নো নিড টু ব্লাফ আস। জাস্ট গেট আউট অব দ্য হাউস।’
লুৎফর রহমান বারান্দা ছাড়লেন। উঠান ছেড়ে বাড়ির প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালেন। একটা নিমগাছের ডালপালা-পাতা তাঁদের মাথার ওপরে ছায়া নাড়তে লাগল।
কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।
সৈনিকেরা বাড়িতে পেট্রল ঢালতে লাগল। গানপাউডার ছিটাল। তারপর ফ্লেয়ার গানের ট্রিগার টিপল বাড়ির দিকে তাক করে। মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে লাগল পুরো বাড়ি।
এর দরজা, জানালা, কপাট, বারান্দা, দোতলা, সিঁড়ি সবখানে আগুন আর আগুন। লুৎফর রহমানের পাশে এসে দাঁড়াল তাঁর কেয়ারটেকার আরশাদ (বয়স ৩৩)।
তার পাশে দাঁড়াল কাশেম (২২), জামিল (১৬)। দাঁড়াল এসে শেফালির মা (৩৮)। শেফালির মা ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘ও মা গো! আগুন দিয়া সব পুড়ায়ে দেল গো...’
সায়েরা খাতুন হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।
লুৎফর রহমান কিছু বলছেন না। শুধু একবার রোদে পোড়া আকাশটার দিকে তাকালেন, আকাশে ধোঁয়া, আকাশে আগুন, আকাশে ছাই।
আগুনে বাড়িটা পুড়ছে। মিলিটারিরা চারপাশে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবের পিতার বাড়ির বহ্ন্যুৎসব প্রত্যক্ষ করছে। তাদের বুটের নিচে কাদা। তাদের পিঠে অনেক বড় বড় ব্যাগ। কোমরভরা গুলি। হাতের মেশিনগানে জলপাই রঙের বেল্টে গুলির সারি। তাদের মাথায় হেলমেট। তাদের চোখে ক্ষুধার্ত হায়েনার ক্রোধ।
আজান হচ্ছে মসজিদে। কে আজান দিচ্ছে?
আগুন নিভে আসছে। অনেকগুলো কুকুর জড়ো হয়ে সৈন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। বাথান থেকে ছুটে পালিয়েছে গরুরা।
আগুনের তেজ কমে এল।
‘ওকে ওল্ডম্যান। আমাদেরকে তোমরা যত ব্যারব্যারিয়ান ভাবো, আমরা তত খারাপ নই। দ্যাখো, তোমাদের বুড়োবুড়ির গায়ে আমরা একটা ফুলের টোকাও দেই নাই। বিদেশি সাংবাদিকেরা এলে বোলো, দ্য কমান্ডার ওয়াজ ভেরি জেন্টল। হি ওয়াজ কাইন্ড অ্যান্ড কনসিডারেট। ওকে। বাই। টেক কেয়ার। ট্রুপস। ফল আউট।’
সৈন্যরা চলে যাচ্ছে। তারা বোধ হয় বাইগার খাল দিয়ে গানবোটে এসেছে। খালের দিকে যাচ্ছে।
আরশাদ বলল, ‘আপনারা কার বাড়িতে এসেছিলেন, জানেন তো। এইটা শেখ বাড়ি। শেখ মুজিবের বাপের ভিটা। দাদার ভিটা। এই বাড়ির একটা নিয়ম আছে। দুপুরের খাবার টাইম হয়েছে। এই বাড়িতে দুপুরে কেউ আইলে না খেয়ে যেতে পারে না। অফিসার, আপনে দুপুরে দুমুঠো “জয় বাংলার ভাত” খেয়ে যাবেন। নালি পরে গৃহস্থের অকল্যাণ হবে।’
‘কী বলল লোকটা?’
একজন দোভাষী কথাটা অনুবাদ করে দিল।
সঙ্গে সঙ্গে হাতের মেশিনগান তুলল অফিসারটা। তাক করল আরশাদের দিকে। ট্রিগারে আঙুল রাখল। পেশাদার আঙুলে চাপ দিল নির্ভুলভাবে। ট্যা ট্যা ট্যা করে একঝাঁক গুলি বেরোতে লাগল। আরশাদের বুক ফুটো হলো, কান উড়ে গেল, কপালে গুলি লেগে করোটির পেছন দিক ফুটো করে মগজ গেল উড়ে। আরশাদ এসে গড়িয়ে পড়ল লুৎফর রহমানের কোলে। লুৎফর রহমান আরশাদকে ধরলেন। পাথরের চোখ দিয়ে তাকালেন একবার অফিসারটার দিকে। সেই চোখে আগুন ছিল।
(সংক্ষেপিত)